অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফিঃ একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হওয়ার গোপন কৌশল

অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি


অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি হল একটি উচ্চতর স্তরের ফটোগ্রাফি যেখানে ফটোগ্রাফারের টেকনিক্যাল দক্ষতা, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি, এবং অভিজ্ঞতার মিশ্রণে এক সুষম চিত্র তৈরি হয়। এটি শুধুমাত্র সাধারণ ছবি তোলার বাইরে গিয়ে ফটোগ্রাফিকে শিল্পে পরিণত করে এবং ফটোগ্রাফারকে তার ব্যক্তিগত স্টাইল ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের সুযোগ দেয় এবং তাঁর দক্ষতা আরও উন্নত করতে সহায়তা করে। অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি একটি চলমান ফটোগ্রাফি শেখার প্রক্রিয়া, যেখানে একজন ফটোগ্রাফার ক্রমাগত নতুন ফটোগ্রাফি কৌশল এবং ধারণা শিখে এবং প্রয়োগ করে। এই নিবন্ধটি মূলত একটি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি বিষয়ক নিবন্ধ। 












অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি
অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি | Image by Gerd Altmann from Pixabay

 

একটি নিবন্ধের মাধ্যমে অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফির বিস্তারিত বর্ণনা করা খুবই কঠিন কাজ, তাছাড়া সব বিষয় এক নিবন্ধে উল্লেখ করলে নিবন্ধটি অনেক বড় হয়ে যাবে এবং তাতে পাঠকের বিরক্তির কারন হবে। তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরবর্তিতে আলোচনা করা হবে, যেমন- ফটোগ্রাফি কম্পোজিশন, ফটোগ্রাফি লাইটিং টেকনিক, বিষয়ভিত্তিক ফটোগ্রাফি ইত্যাদি। ইতিপূর্বে বেসিক ফটোগ্রাফির বিষয়ে নিবন্ধ লেখা হয়েছে। বেসিক ফটোগ্রাফি ও অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি সঠিকভাবে আয়ত্ত্ব করতে পারলে একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন আশা করি। অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি নিবন্ধটি একটি ফটোগ্রাফি গাইড হিসেবে কাজ করবে। নিবন্ধটিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফটোগ্রাফি টিপস সংযোজন করা হয়েছে, যেমন- হাইপারফোকাল ডিস্টেন্স যা বোনাস হিসেবে সংযোজিত। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, বেসিক ফটোগ্রাফিতে বলেছিলাম- বেসিক ফটোগ্রাফি শিখতে ডিএসএলআর ক্যামেরা আবশ্যিক নয় কিন্তু অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফি প্র্যাকটিস করতে অবশ্যই একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা আবশ্যিক।



বেসিক ফটোগ্রাফি সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন


এই পর্বে আমরা অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপঃ


 

অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফির মূল বৈশিষ্ট্য


১. ক্যামেরা ইন্সট্রুমেন্টস (Camera Instruments)
২. ক্যামেরা কন্ট্রোল বা ক্যামেরা সেটিং (Camera Control / Camera Settings)
৩. শার্পনেস (Sharpness)
৪. ডেপথ অফ ফিল্ড (Depth of Field)
৫. ফটোগ্রাফি কম্পোজিশন (Photography Composition)
৬. ফটোগ্রাফি লাইটিং টেকনিক (Photography Lighting Technique)
৭. স্পেশালাইজড শুটিং টেকনিক (Specialized Shooting Technique)
৮. পোস্ট-প্রসেসিং এবং ফটো এডিটিং (Post Processing & Photo Editing)



১. ক্যামেরা ইন্সট্রুমেন্টস (Camera Instruments)


ক্যামেরা ইন্সট্রুমেন্টস (Camera Instruments) হল সেই সমস্ত যন্ত্র এবং সরঞ্জাম যা একটি ক্যামেরার কার্যক্ষমতা এবং কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্যামেরার ইনস্ট্রুমেন্টস বিভিন্ন ধরণের হতে পারে, যেমন লেন্স, ট্রাইপড, ফিল্টার, এবং বিভিন্ন ধরনের অ্যাকসেসরিজ, যা ফটোগ্রাফির প্রয়োজনীয়তা এবং ফটোগ্রাফারদের কাজকে সহজতর করতে সহায়ক।


ক্যামেরা ইন্সট্রুমেন্টস হল ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রের অপরিহার্য উপাদান যা ক্যামেরার কার্যকারিতা এবং ফটোগ্রাফির গুণমান বাড়াতে সাহায্য করে। সঠিক যন্ত্র ব্যবহার করে, ফটোগ্রাফাররা উন্নত প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতার মিশ্রণে চমৎকার ছবি তোলার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। ক্যামেরা ইনস্ট্রুমেন্টস এর কার্যকর ব্যবহার ফটোগ্রাফির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে ছবি তোলার জন্য সাহায্য করে।



১.১ লেন্স: 


ক্যামেরা লেন্স হল একধরনের অপটিক্যাল লেন্স বা লেন্সের সমাবেশ যা ক্যামেরার বডি এবং মেকানিজমের সাথে যুক্ত হয়ে বস্তুর ছবি তৈরি করে। এটি ক্যামেরার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলির মধ্যে একটি, কারণ এটিই ছবির মান এবং গুণগত মান নির্ধারণ করে। একটি ক্যামেরা লেন্স আলোকে সংগ্রহ করে এবং তাকে একটি ফোকাস পয়েন্টে কেন্দ্রীভূত করে। এই ফোকাস পয়েন্টে একটি ইমেজ সেন্সর বা ফিল্ম থাকে, যা আলোকে ধরে রেখে একটি ডিজিটাল ছবি বা ফিল্ম নেগেটিভ তৈরি করে।


১.১.১ লেন্সের বিভিন্ন ধরনঃ




  • প্রাইম লেন্স: ফিক্সড ফোকাল লেন্থের লেন্স, অর্থাৎ এটি জুম করতে পারে না। সাধারণত খুব ধারালো এবং বেশি অ্যাপারচার (যেমন f/1.4 বা f/1.8) প্রদান করে। এগুলি সাধারণত জুম লেন্সের তুলনায় তীক্ষ্ণ ছবি তৈরি করে এবং আলোকে আরও ভালভাবে ধরে রাখে। পোর্ট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ, স্ট্রিট ফটোগ্রাফির জন্য প্রাইম লেন্স খুব জনপ্রিয়।



  • জুম লেন্স: বিভিন্ন ফোকাল লেন্থের সুবিধা রয়েছে, অর্থাৎ জুম ইন ও আউট করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, 24-70mm, 70-200mm ইত্যাদি। জুম লেন্স ভ্রমণ, ইভেন্ট, ওয়াইল্ডলাইফ, এবং স্পোর্টস ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ, যেখানে সাবজেক্টের দূরত্ব বিভিন্ন হতে পারে।



  • ওয়াইড-এঙ্গেল লেন্স: এই ধরনের লেন্স বৃহৎ এলাকা কভার করার জন্য ব্যবহৃত হয়। 35mm বা এর চেয়ে কম ফোকাল লেন্থের লেন্স, যা বিস্তৃত দৃশ্য ধারণ করতে সহায়তা করে। ল্যান্ডস্কেপ, আর্কিটেকচার এবং ইনডোর ফটোগ্রাফির জন্য ব্যবহার করা হয়।



  • টেলিফোটো লেন্স: এই ধরনের লেন্স দূরের বস্তুর ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত হয়। 70mm এর বেশি ফোকাল লেন্থের লেন্স, যা দূরের সাবজেক্টকে কাছে নিয়ে আসে। ওয়াইল্ডলাইফ, স্পোর্টস এবং অ্যাকশন ফটোগ্রাফির জন্য জনপ্রিয়।



  • ম্যাক্রো লেন্স: ছোট ছোট বস্তু বা সাবজেক্টের বিশদ বিবরণ (ডিটেইল) ধারণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। উচ্চ মানের ক্লোজ-আপ শট তোলে। ফুল, পোকামাকড় বা ক্ষুদ্র বস্তু ফটোগ্রাফির জন্য ব্যবহৃত হয়। ।



  • ফিশ আই লেন্স: অত্যন্ত প্রশস্ত ভিউ এঙ্গেল প্রদান করে এবং চিত্রকে গোলাকৃতি বা ডিসটোর্টেড করে তুলতে পারে। সৃজনশীল বা আর্ট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।



১.১.২ লেন্সের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যঃ

  • অ্যাপারচার (f-stop): অ্যাপারচার লেন্সের সেই অংশ যা আলোকে প্রবেশের জন্য খোলা হয়। বড় অ্যাপারচার (ছোট f-stop যেমন f/1.8) বেশি আলো প্রবেশ করতে দেয় এবং শ্যালো ডেপথ অব ফিল্ড তৈরি করে, যা ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।



  • ফোকাল লেন্থ: এটি নির্ধারণ করে কতটা বড় বা ছোট ফ্রেমে সাবজেক্টকে দেখা যাবে। ছোট ফোকাল লেন্থ বেশি বিস্তৃত দৃশ্য ধারণ করে এবং বড় ফোকাল লেন্থ সাবজেক্টকে কাছে নিয়ে আসে।



  • স্ট্যাবিলাইজেশন: লেন্সের মধ্যে স্ট্যাবিলাইজেশন থাকলে, হাত কাঁপলে বা নড়াচড়ায় ইমেজ ব্লার হওয়া কম হয়।



  • অপটিক্যাল কোয়ালিটি: লেন্সের কাচের মান এবং অপটিক্যাল ডিজাইন ইমেজের শার্পনেস, কনট্রাস্ট এবং রঙের গুণগত মানকে প্রভাবিত করে।


 

১.২ ফিল্টার:


ফিল্টার ক্যামেরার লেন্সের সামনে বসানো হয় এবং আলোর প্রবাহ, রঙ, এবং কনট্রাস্ট নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ ফিল্টারের মধ্যে ইউভি (UV) ফিল্টার, পোলারাইজার ফিল্টার, নিউট্রাল ডেনসিটি (ND) ফিল্টার, এবং গ্র্যাডুয়েটেড ফিল্টার অন্তর্ভুক্ত। ইউভি (UV) ফিল্টার একটি স্বচ্ছ ফিল্টার, যা অতিবেগুনি (Ultra Violet) রশ্মি ব্লক করতে সহায়তা করে, পোলারাইজার ফিল্টার প্রতিফলন কমাতে সাহায্য করে, ND ফিল্টার এক্সপোজার সময় বাড়ায় এবং গ্র্যাডুয়েটেড ফিল্টার আকাশ এবং ভূমির আলোর পার্থক্য সমন্বয় করে। ফিল্টার ব্যবহার করে ছবির আলো এবং শ্যাডো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।



১.৩ ট্রাইপড ও মনোপড:



  • ট্রাইপড: ট্রাইপড একটি তিন পায়ের স্ট্যান্ড যা ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, বা অন্যান্য ফটোগ্রাফিক সরঞ্জামকে স্থিরভাবে ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ফটোগ্রাফির গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম, বিশেষ করে যখন দীর্ঘ এক্সপোজার, লো লাইট কন্ডিশন, বা স্থির ও ধারালো ছবি তোলার প্রয়োজন হয়। ট্রাইপড ক্যামেরাকে সম্পূর্ণ স্থির রাখে, যা দীর্ঘ এক্সপোজার শট, টাইম-ল্যাপস ফটোগ্রাফি, বা লো লাইটে শার্প ইমেজ ক্যাপচার করার জন্য প্রয়োজনীয়। এটি হ্যান্ডশেক বা ক্যামেরার নড়াচড়া থেকে সৃষ্ট ব্লার কমিয়ে দেয়। ট্রাইপড ভারী ক্যামেরা এবং লেন্সের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। টেলিফটো লেন্স ব্যবহারের সময় ট্রাইপড বিশেষভাবে কার্যকর। ট্রাইপড ব্যবহার করলে আপনি সাবধানে কম্পোজিশন করতে এবং সাবজেক্টের সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন, কারণ ক্যামেরা স্থির থাকে। নাইট ফটোগ্রাফি, লাইট ট্রেইল, বা স্টার ট্রেইল ফটোগ্রাফির জন্য ট্রাইপড অপরিহার্য, কারণ এটি দীর্ঘ সময় ধরে ক্যামেরাকে এক জায়গায় স্থির রাখে। ট্রাইপড ভিডিও রেকর্ডিংয়ের সময় ক্যামেরাকে স্থিতিশীল রাখে এবং প্যান ও টিল্ট করার সময় সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে। বাজারে বিভিন্নরকমের ট্রাইপড পাওয়া যায়, যেমন- ফুল-সাইজ ট্রাইপড: সাধারণত ভারী এবং স্থিতিশীল, যা স্টুডিও বা স্থির অবস্থায় ব্যবহারের জন্য আদর্শ; ট্রাভেল ট্রাইপড: হালকা ও পোর্টেবল, যা ভ্রমণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি সহজে ফোল্ড করা যায় এবং ক্যামেরা ব্যাগে বহন করা যায়; টেবিলটপ ট্রাইপড: ছোট আকারের, যা টেবিল বা অন্যান্য ফ্ল্যাট সারফেসে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত; গরিলা ট্রাইপড: নমনীয় পা থাকার কারণে এটি বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠে স্থাপন করা যায় বা মোড়ানো যায়, যা বহুমুখী ফটোগ্রাফির জন্য কার্যকর।



  • মনোপড: মনোপড একটি এক পায়ের স্ট্যান্ড যা ক্যামেরা বা অন্য যেকোনো ফটোগ্রাফিক সরঞ্জামকে স্থিতিশীলভাবে ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি ট্রাইপডের মতো তিন পায়ের স্ট্যান্ডের তুলনায় কম ভারী এবং সহজে বহনযোগ্য। মনোপড ক্যামেরা হ্যান্ডশেক (হাত কাঁপা) কমাতে সাহায্য করে, যা বিশেষত লং এক্সপোজার শট বা টেলিফটো লেন্স ব্যবহারের সময় গুরুত্বপূর্ণ। এটি সাধারণত হালকা ওজনের এবং সহজে বহনযোগ্য, তাই ভ্রমণ ফটোগ্রাফি বা অ্যাকশন ফটোগ্রাফির জন্য উপযুক্ত। মনোপড খুব দ্রুত সেটআপ করা যায় এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা সহজ। এটি আপনাকে দ্রুত ক্যামেরা অবস্থান পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। ওয়াইল্ডলাইফ বা স্পোর্টস ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে মনোপড খুব কার্যকর, যেখানে ভারী টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করা হয়। ট্রাইপডের তুলনায় মনোপডে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল দ্রুত পরিবর্তন করা যায়, যা কিছু সৃজনশীল শট নিতে সহায়ক। ট্রাইপডের মতো সম্পূর্ণ স্থিরতা প্রদান করতে পারে না, তাই দীর্ঘ এক্সপোজার বা স্টিল ল্যান্ডস্কেপ শটের জন্য ট্রাইপড বেশি কার্যকর।


 

১.৪ রিমোট শাটার রিলিজ:


রিমোট শাটার রিলিজ একটি ডিভাইস যা ক্যামেরার শাটার মুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়, যাতে ক্যামেরা সেলফি বা স্ট্যাবল ফটোগ্রাফি নিশ্চিত করা যায়। এটি ছবি তোলার সময় ক্যামেরার কম্পোজিশন বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ক্যামেরার কাঁপুনি কমাতে সহায়ক। রিমোট শাটার রিলিজ ব্যবহার করে ক্যামেরার স্থিরতা এবং নিয়ন্ত্রণ উন্নত করা যায়।

 

১.৫ ফ্ল্যাশ:


ফ্ল্যাশ হল একটি আলোর উৎস যা কম আলোতে অথবা ইচ্ছামতো আলো যোগ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ক্যামেরায় অন্তর্নির্মিত বা বাইরের ইউনিট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফ্ল্যাশ সাধারণত রাতের সময় বা নিম্ন আলোতে ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়, এবং এটি আলো উন্নত করতে সহায়ক। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে ছবির আলো এবং শ্যাডো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ফ্ল্যাশ হলো এমন একটি লাইট যা একটি মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠে এবং আলোকিত করে। ফটোগ্রাফিতে, বিশেষ করে পোর্ট্রেট এবং স্টুডিও ফটোগ্রাফিতে ফ্ল্যাশের ব্যবহার প্রচলিত। ফ্ল্যাশের প্রকারভেদ: On-Camera Flash, Off-Camera Flash, Ring Flash, Speedlight। Speedlight: এটি ক্যামেরার উপরে লাগানো একটি পোর্টেবল ফ্ল্যাশ ইউনিট, যা মোবাইল স্টুডিওর জন্য আদর্শ। Off-Camera Flash: ক্যামেরা থেকে আলাদা রেখে নিয়ন্ত্রিত আলোর জন্য ব্যবহার করা হয়।

 

১.৬ সফটবক্স (Softbox): 


সফটবক্স হলো একটি লাইট মডিফায়ার, যা আলোর সুত্রকে ঢেকে রেখে নরম এবং ছড়ানো আলো প্রদান করে। এটি স্টুডিও এবং পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফিতে ব্যবহার করা হয়, যেখানে হালকা ছায়া এবং মসৃণ আলো প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন আকার এবং শেপে পাওয়া যায়, যেমন Square, Rectangular, Octagonal ইত্যাদি।

 

১.৭ আম্ব্রেলা (Umbrella): 


ফটোগ্রাফিতে ব্যবহার করা লাইট মডিফায়ার, যা ফ্ল্যাশ বা কন্টিনিউয়াস লাইটের আলো ছড়াতে সাহায্য করে। Shoot-Through Umbrella: এর মাধ্যমে আলো সরাসরি ছড়িয়ে পড়ে, ফলে নরম এবং ছায়াহীন আলো তৈরি হয়। Reflective Umbrella: এতে আলো প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে, যা ফ্ল্যাশের আলোকে নরম করে দেয়।

 

১.৮ রিফ্লেক্টর (Reflectors): 


এটি একটি সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ লাইটিং ইন্সট্রুমেন্ট, যা আলোকে প্রতিফলিত করে এবং ছায়া হালকা করতে সাহায্য করে। রিফ্লেক্টরের বিভিন্ন রঙের ভ্যারিয়েশন থাকে, যেমন সিলভার, গোল্ড, হোয়াইট, ব্ল্যাক। সিলভার রিফ্লেক্টর দিয়ে শক্তিশালী আলো দেওয়া যায়, গোল্ড রিফ্লেক্টর দিয়ে উষ্ণ টোন আনা যায়, হোয়াইট রিফ্লেক্টর দিয়ে নরম আলো দেওয়া যায়, এবং ব্ল্যাক রিফ্লেক্টর আলো শোষণ করতে ব্যবহৃত হয়।

 

১.৯ লাইট স্ট্যান্ড (Light Stands): 


লাইট স্ট্যান্ড হলো একটি স্ট্যান্ড, যার উপর লাইট মাউন্ট করা হয়। এটি বিভিন্ন উচ্চতায় এবং কোণে আলো স্থাপন করতে সাহায্য করে।

 

১.১০ ডিফিউজার (Diffusers): 


ডিফিউজার হলো এমন একটি সরঞ্জাম, যা আলোকে নরম করে ছড়িয়ে দেয়। এটি ফ্ল্যাশের সামনে বা কন্টিনিউয়াস লাইটের সামনে স্থাপন করা হয়, যাতে হালকা এবং সমান আলো পাওয়া যায়।

 

১.১১ রিং লাইট (Ring Light): 


রিং লাইট হলো বৃত্তাকার আকারের একটি লাইট, যা সাধারণত পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি, বিউটি শুট এবং ভিডিওগ্রাফিতে ব্যবহার করা হয়। এটি সাবজেক্টের চারপাশে একটি সমান এবং ছায়াহীন আলো প্রদান করে, যা চোখে একটি সুন্দর রিং আকৃতির প্রতিফলন তৈরি করে।

 

১.১২ জেলস এবং ফিল্টার (Gels and Filters): 


জেলস হলো রঙিন ফিল্টার, যা লাইটের রঙ পরিবর্তন করতে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন লাইট ইফেক্ট বা মুড তৈরি করার জন্য ফটোগ্রাফিতে জেলস ব্যবহার করা হয়।

 

১.১৩ বার্ন ডোরস (Barn Doors): 


বার্ন ডোর হলো ফ্ল্যাশ বা কন্টিনিউয়াস লাইটের সাথে সংযুক্ত চারটি মেটাল ফ্ল্যাপ, যা আলোর দিক এবং আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয়।

 

১.১৪ এক্সটারনাল মাইক্রোফোন (External Microphone):


এক্সটারনাল মাইক্রোফোন ক্যামেরায় উন্নত অডিও রেকর্ডিং এর জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত ভিডিও ফটোগ্রাফির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভিডিওর সময় স্পষ্ট এবং উন্নত অডিও নিশ্চিত করতে এটি ব্যবহৃত হয়।

 

১.১৫ মেমরি কার্ড (Memory Card):


মেমরি কার্ড ক্যামেরার ছবির তথ্য সংরক্ষণ করে। এটি বিভিন্ন ক্যাপাসিটিতে আসে, যেমন SD কার্ড, CF কার্ড ইত্যাদি। ফটোগ্রাফির তথ্য সংরক্ষণ এবং ট্রান্সফার করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।

 

১.১৬ ব্যাগ প্যাক এবং ক্যামেরা ব্যাগ (Camera Bag):


ক্যামেরা ব্যাগ এবং ব্যাগ প্যাক ক্যামেরার উপকরণ এবং এক্সেসরিজ সংরক্ষণ এবং পরিবহন করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ক্যামেরা এবং লেন্সের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করে। বিভিন্ন সাইজ এবং স্টাইলে ক্যামেরা ব্যাগ এবং বেগ প্যাক পাওয়া যায়, যা ক্যামেরা এবং আনুষাঙ্গিকগুলি সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।

 

 

২. ক্যামেরা কন্ট্রোল বা ক্যামেরা সেটিংস (Camera Control / Camera Settings)


অ্যাডভান্স ফটোগ্রাফির অন্যতম প্রধান দিক হল ক্যামেরার ম্যানুয়াল মোডে কাজ করার মাধ্যমে এক্সপোজার কন্ট্রোল করা। ফটোগ্রাফাররা অ্যাপারচার, শাটার স্পিড, এবং আইএসও-এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এক্সপোজার কন্ট্রোল করেন বা আলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করেন। ইতিমধ্যে বেসিক ফটোগ্রাফিতে এক্সপোজার কন্ট্রোল (অ্যাপারচার, শাটার স্পিড, এবং আইএসও) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই পর্বে ক্যামেরা সেটিংয়ের অন্যান্য বিষয় বা বিভিন্ন ক্যামেরা টেকনিক নিয়ে আলোচনা করবো।

 

ক্যামেরা সেটিংস ফটোগ্রাফির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আপনি আপনার ছবির গুণমান এবং শৈল্পিকতা উভয়ই বৃদ্ধি করতে পারবেন। ক্যামেরার প্রধান কিছু সেটিংস এবং তাদের ভূমিকা নিম্নরূপ:



২.১ অ্যাপারচার (Aperture)


লেন্সের ভিতরের একটি খোলা ছিদ্র, যা লেন্সের মধ্যে দিয়ে আলো প্রবেশ করতে দেয়। অ্যাপারচার কন্ট্রোল করে যে কতটা আলো ক্যামেরার সেন্সরে পৌঁছাবে। এটি ছবির গভীরতা (Depth of Field) নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যাপারচার f-stop দ্বারা প্রকাশ করা হয়, যেমন f/2.8, f/4, f/8 ইত্যাদি। ছোট f-stop মানে বড় অ্যাপারচার, বেশি আলো; বড় f-stop মানে ছোট অ্যাপারচার, কম আলো। f/2.8 বড় অ্যাপারচার, পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির জন্য ভালো। f/16 ছোট অ্যাপারচার, ল্যান্ডস্কেপের জন্য ভালো। বেসিক ফটোগ্রাফিতে অ্যাপারচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

২.২ শাটার স্পিড (Shutter Speed)


সময়কাল, যতক্ষণ ক্যামেরার শাটার খোলা থাকে এবং আলো সেন্সরে পড়তে পারে। শাটার স্পিড কন্ট্রোল করে যে ছবিটি কত দ্রুত বা ধীরে তোলা হবে। দ্রুত শাটার স্পিড চলমান বিষয়ের ছবি স্থির করতে সাহায্য করে, ধীর শাটার স্পিড মোশন ব্লার তৈরি করে। এটি সেকেন্ড বা সেকেন্ডের অংশ দ্বারা প্রকাশ করা হয়, যেমন 1/500, 1/60, 1", ইত্যাদি। 1/1000 সেকেন্ড হলো দ্রুত শাটার স্পিড, স্পোর্টস বা ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির জন্য ভালো, 30 সেকেন্ড থেকে -30 ধীর শাটার স্পিড, লং এক্সপোজার ফটোগ্রাফির জন্য ভালো। বেসিক ফটোগ্রাফিতে অ্যাপারচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।



২.৩ আইএসও (ISO)


ক্যামেরার সেন্সরের আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা। ISO কন্ট্রোল করে ছবির ব্রাইটনেস। কম আইএসও মানে কম আলোক সংবেদনশীলতা, বেশি আইএসও মানে বেশি আলোক সংবেদনশীলতা। ISO এর মান সাধারণত 100 থেকে 8000 বা তারও বেশি হতে পারে। ISO 100 কম আলোতে ন্যাচারাল লুকের জন্য ভালো, ISO 3200 অল্প আলোতে দ্রুত শুটিংয়ের জন্য ভালো কিন্তু গ্রেইন বা নোইস বাড়তে পারে। বেসিক ফটোগ্রাফিতে অ্যাপারচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।



২.৪ ফটোগ্রাফি মোড


ফটোগ্রাফি মোডগুলি ক্যামেরার বিভিন্ন সেটিংস বা প্রিসেট, যা ফটোগ্রাফারের নির্দিষ্ট শুটিং পরিস্থিতিতে সহজ এবং কার্যকরভাবে ছবি তোলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। প্রতিটি মোড আলাদা আলাদা এক্সপোজার এবং ফোকাস সেটিংস ব্যবহার করে, যা বিভিন্ন আলোক পরিস্থিতিতে ফটোগ্রাফারকে সাহায্য করে।



২.৪.১ সাধারণ ফটোগ্রাফি মোডসমূহ:



  • ম্যানুয়াল মোড (M): ম্যানুয়াল মোডে ফটোগ্রাফার ক্যামেরার সমস্ত সেটিংস, যেমন অ্যাপারচার, শাটার স্পিড, এবং আইএসও নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করেন। এটি সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে এবং জটিল পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হয়।



  • অ্যাপারচার প্রায়োরিটি মোড (A বা Av): এই মোডে ফটোগ্রাফার অ্যাপারচার ঠিক করেন, এবং ক্যামেরা শাটার স্পিড স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামঞ্জস্য করে। এটি তখন ব্যবহার করা হয় যখন আপনি ছবির ডেপথ অব ফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করতে চান।



  • শাটার প্রায়োরিটি মোড (S বা Tv): এই মোডে ফটোগ্রাফার শাটার স্পিড ঠিক করেন, এবং ক্যামেরা অ্যাপারচার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামঞ্জস্য করে। এটি দ্রুত গতির শট বা মোশন ব্লার তৈরি করতে সহায়ক।



  • প্রোগ্রাম মোড (P): প্রোগ্রাম মোডে ক্যামেরা অ্যাপারচার এবং শাটার স্পিড উভয়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ফটোগ্রাফার শুধুমাত্র আইএসও বা এক্সপোজার কম্পেনসেশন সামঞ্জস্য করতে পারেন। এটি দ্রুত এবং সহজ শুটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।



  • অটো মোড: অটো মোডে ক্যামেরা সমস্ত সেটিংস স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী, যারা ফটোগ্রাফির জটিলতায় না গিয়ে সহজে ছবি তুলতে চান।



  • পোর্ট্রেট মোড: পোর্ট্রেট মোডে ক্যামেরা অ্যাপারচার বড় করে, যাতে ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার হয় এবং বিষয় স্পষ্ট থাকে। এটি সাধারণত পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির জন্য ব্যবহার করা হয়।



  • ল্যান্ডস্কেপ মোড: ল্যান্ডস্কেপ মোডে ক্যামেরা অ্যাপারচার ছোট করে, যাতে ছবির সামনের এবং পেছনের সবকিছুই ফোকাসে থাকে। এটি প্রাকৃতিক দৃশ্য বা আর্কিটেকচার ফটোগ্রাফির জন্য ব্যবহার করা হয়।



  • ম্যাক্রো মোড: ম্যাক্রো মোড ছোট বিষয় বা ডিটেইলের ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত ক্লোজ-আপ শটের জন্য কার্যকর।



  • নাইট মোড: নাইট মোড লো লাইট কন্ডিশনে বা রাতে ছবি তোলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এতে শাটার স্পিড কমিয়ে এবং আইএসও বাড়িয়ে আলো ধরে রাখা হয়।



  • স্পোর্টস মোড: স্পোর্টস মোড দ্রুত গতির বিষয়বস্তুর ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি দ্রুত শাটার স্পিড ব্যবহার করে, যাতে চলমান বিষয় স্পষ্ট থাকে।



  • প্যানোরামা মোড: প্যানোরামা মোড একটি বড় আঙ্গলের ছবি বা দৃশ্য ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। ক্যামেরা একাধিক ছবি নিয়ে তাদের একটি প্যানোরামা ছবিতে যুক্ত করে।



  • HDR মোড: এই মোডে ক্যামেরা বিভিন্ন এক্সপোজারে একাধিক ছবি তুলে এবং তাদের সংযুক্ত করে, যাতে ছবিতে হাইলাইট এবং শ্যাডোগুলো ঠিকমতো প্রকাশ পায়।



২.৫ এক্সপোজার কম্পেনসেশন (Exposure Compensation)


এক্সপোজার কমপেনশন (Exposure Compensation) হল একটি ক্যামেরার ফিচার যা ফটোগ্রাফারদের ছবির এক্সপোজার সমন্বয় করতে সহায়তা করে। এটি ক্যামেরার অটো এক্সপোজার সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটি ছবির উজ্জ্বলতা বা অন্ধকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্সপোজার কমপেনশন ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি ছবির প্রয়োজনীয় উজ্জ্বলতা অর্জন করতে পারেন। এটি ফটোগ্রাফারদের সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে এবং বিভিন্ন আলোর পরিস্থিতিতে সঠিক এক্সপোজার অর্জনে সাহায্য করে। সঠিকভাবে এক্সপোজার কমপেনশন ব্যবহার করে আপনি আপনার ছবির গুণমান এবং প্রফেশনালিজম উন্নত করতে পারেন।


 

২.৫.১ এক্সপোজার কমপেনশন কীভাবে কাজ করে?


এক্সপোজার কমপেনশন ক্যামেরার এক্সপোজার সেটিংস, যেমন শাটার স্পিড, অ্যাপারচার, এবং আইএসও এডজাস্ট করে। এক্সপোজার কমপেনশন সাধারণত ±১ স্টপ বা ±২ বা ±৩ স্টপ পর্যন্ত সামঞ্জস্যের বিকল্প প্রদান করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *